পাটকাঠির ছাইয়ের কেজি ৬০ টাকা, আশা দেখছেন কৃষকরা

চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে পাঠকাঠির ছাই। এটি ‘চারকোল’ নামেও পরিচিত। ২০১২ সাল থেকে পণ্যটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়মিত রফতানি করা হচ্ছে। এ বছর প্রতি কেজি পাটকাঠির ছাই রফতানি হয়েছে ৬০ থেকে ৬২ টাকায়। এর দাম আরও বাড়ানো সম্ভব।

চাহিদা থাকায় ব্যতিক্রমী এ পণ্যের রফতানি প্রতি বছর বাড়ছে। এক সময় শুধু চীনকেন্দ্রিক রফতানির বাজার থাকলেও এখন এ ছাই বা চারকোল যাচ্ছে কানাডা, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক ও কোরিয়াসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে। সে কারণে বাড়ছে ছাই উৎপাদনের কারখানাও। সারাদেশে প্রায় ৩০টি চারকোল কারখানা রয়েছে।

এসব কারখানা মালিক ও রফতানিকারকদের একটি সংগঠনও গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ চারকোল ম্যানুফ্যাকচারস অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিসিএমইএ) দেয়া তথ্য বলছে, গত অর্থবছর (২০১৯-২০) চারকোল রফতানি হয়েছে ৪১৮২ দশমিক ২৭ মেট্রিক টন। প্রতি টনের মূল্য প্রায় ৭০০ ডলার।

দেশে ২০১২ সালে প্রথম পাটকাঠি থেকে চারকোল তৈরি হয়
বিসিসিএমইএ’র সভাপতি মির্জা জিল্লুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, বর্তমানে এ খাতটি প্রচুর সম্ভাবনাময়। আমাদের দেশে ৩০ লাখ টনের বেশি পাটকাঠি উৎপাদন হয়। এর কিছু অংশ পার্টিকেল বোর্ড তৈরিতে ব্যবহার হয়। বাকিটা এ খাতে কাজে লাগানো গেলে বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

২০১৫ সালে যশোরে প্যানাসিয়া কার্বন লিমিটেড নামে চারকোল উৎপাদনের কারখানা গড়ে তোলেন এ কে আজাদ। পরের বছরই তিনি শুরু করেন রফতানি। গত বছর তার প্রতিষ্ঠান থেকে রফতানি হয়েছে ৫ লাখ ডলারের চারকোল।

আজাদ বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ নীতি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পেলে প্যানাসিয়া কার্বনের রফতানি কয়েক বছরের মধ্যে ৫০ লাখ ডলারে পৌঁছাবে। এখন এ প্রতিষ্ঠানে ৩২ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, পরে তা চারগুণ হবে।

দেশে উৎপাদিত পাট দিয়ে বৈদেশি মুদ্রা অর্জন ও নানা কাজে ব্যবহার হলেও পাটকাঠি আগে গ্রামে শুধু রান্না এবং বেড়া দেয়ার কাজেই ব্যবহৃত হতো। প্রথম দেশের বোর্ড কারখানাগুলোতেও উপকরণ হিসেবে পাটখড়ি ব্যবহার শুরু করে। বাকি অংশটি ২০১২ সালে চারকোল বানিয়ে তা রফতানির পথ দেখান ওয়াং ফেই নামের চীনের এক নাগরিক। ওই বছরই দেশে সর্বপ্রথম পাটকাঠি থেকে অ্যাকটিভেটেড চারকোল তৈরি এবং তা চীনে রফতানি করা হয়।

চারকোলে আশা দেখছেন কৃষকরা, গড়ে উঠছে কারখানা
পাটকাঠিকে ৪৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বিশেষ চুল্লির মাধ্যমে পুড়িয়ে প্রাথমিকভাবে কয়লা তৈরি করে বিশেষ ক্রাশার মেশিনের মাধ্যমে ক্রাশিং করে চারকোল তৈরি করা হয়। এর প্রধান উপাদান কার্বন যার চাহিদা ব্যাপক। সাধারণত এক মণ চারকোল উৎপাদনে গড়ে খরচ হয় ৩০-৩৫ টাকা অথচ বিক্রি করা যায় ৭৫-৯০ টাকায়। তুষকেও মেশিনের সাহায্যে বিশেষ প্রক্রিয়ায় চারকোলে পরিণত করা হয়।

জানা গেছে, পাটকাঠির কয়লা থেকে বিদেশে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, আতশবাজি এবং ফেসওয়াশের উপকরণ, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি, প্রসাধন সামগ্রী, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি হয়। দেশেও এ কয়লা থেকে পণ্য উৎপাদনের সীমিত আকারে কাজ হচ্ছে।

এদিকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইতোমধ্যে দেশের সব জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছ থেকে ছাই উৎপাদন ও রফতানিবিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করেছে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। এ নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে রফতানির পথ আরও সুগম হবে। এছাড়া নানা সহায়তা পাবেন উদ্যোক্তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাট অধিদফতরের মহাপরিচালক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চারকোলেরর নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। এ নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। একটি টেকনিক্যাল কমিটি নীতিমালা প্রস্তুতে কাজ করছে।

দেশে প্রায় ৩০টি চারকোল কারখানা রয়েছে
পাট অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশে বছরে ৩০ লাখ টন পাটখড়ি উৎপাদন হয়। এর মাত্র ৫০ শতাংশকেও যদি ছাই করা যায়, তাহলে বছরে উৎপাদন দাঁড়াবে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার টন। এক টন চারকোলের দাম ৭০০ থেকে মানভেদে ১ হাজার ডলার পর্যন্ত।

যশোরের পাশাপাশি চারকোল তৈরির কারখানাগুলো বেশি গড়ে উঠেছে ফরিদপুর, জামালপুর, ঝিনাইদহ, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, লালমনিরহাট ও রাজবাড়ীতে। এসব এলাকায় পাটের আঁশের পাশাপাশি দাম ভালো পাওয়ায় পাটকাঠি কৃষকরা আশার আলো দেখছেন। অনেক এলাকায় পাটের চেয়ে পাটকাঠির দাম তুলনামূলক বেশি। ওইসব এলাকার চাষিরা এখন অবহেলিত পাটখড়ির দিকে নজর দিচ্ছেন বেশি।

সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, চলতি (২০২০-২১) মৌসুমে জেলার সাতটির মধ্যে ছয়টি উপজেলায় পাট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার বেল। ২০১৯-২০ মৌসুমে জেলায় এক লাখ ৩৭ হাজার ৬২৪ বেল পাট উৎপাদন হয়। এই উৎপাদন কয়েক বছর আগেই এক লাখ বেলের নিচে ছিল। এ এলাকায় পাঠখড়ির চড়া মূল্যের কারণেই পাটের উৎপাদন বাড়ছে।